লঞ্চে চড়ে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে গেল। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে
দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলো।
আমরা থানার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। থানার মধ্যে গিয়ে দেখি ৩জন পুলিশ ও ২জন
রাজাকার গুলিতে মারা গেছে। সেন্ট্রি সহ থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত হাত
বেঁধে ধরে নিয়ে এলাম। ভোর হয়ে গেল। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করা দলটিও
এলো। মতিন সাহেব পালিয়ে গেছে। তাকে ধরা সম্ভব হয় নাই। থানার আশেপাশের
লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল। বিজয়ী হয়ে চলে এলাম।
পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকি হানাদার এসে থানার আশে পাশে আগুন
দিয়েছিল এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিল।
০২। কালিয়া হরিপুর স্টেশন সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প
এ্যাম্বুস। কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার একটি রেলওয়ে
স্টেশন। এই এ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রæপ কমান্ডার জনাব এম.এ
মান্নান স্যার। ৪ নভেম্বর’৭১ আমাদের গ্রæপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের
এম,এন, এ জনাব মোঃ মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামীলীগ নেতা
জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন
সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস করেছিলাম। কমান্ডার স্যার
ক্রোলিং করে রেল লাইনে বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে আসলেন। তথ্য ছিল ঈশ্বরদী থেকে
পাকি হানাদার নিয়ে একটি ট্রেন সিরাজগঞ্জ যাবে। কমান্ডার স্যার ট্রেনটি
উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকলাম।
কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারী। টর্চ লাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি
মিলি শিয়া ও রাজাকারেরা টহল দিচ্ছিল। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার
বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মাইনটি ওদের নজরে পড়লো। হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের লাইং
পজিশনে রেডি থাকতে বললো। আমাদের দিকে টর্চ লাইট মেরে মেরে উর্দূতে
বকাবকি করতে থাকলো। ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ গামী পাকি হানাদার
বাহী ট্রেন এলো। পাকি হানাদারেরা সিগন্যাল দিল। ষ্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিল।
ট্রেনের পাকি হানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমাদেরকে খুঁজতে
থাকলো। আমাদের মাইনটি ব্রাষ্ট করা সম্ভব হলো না। পাকি হানাদারদের
সংখ্যাধিক্যতায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড
করলেন। পরের দিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকি হানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া
হরিপুরের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং গ্রামের অনেককে ধরে নির্যাতন
করেছিল। আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রীজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস
থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। কমান্ডার
স্যারের মা আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা কমান্ডার স্যারের
বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের সবাইকে বসিয়ে কমান্ডার
স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয় ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশ কিছু যুবককে আমাদের
গ্রæপে ভর্তি করা হয়েছিল। এত বড় প্লাটুন এক শেল্টারে শেল্টার নেওয়া সমস্যা।
তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কে কমান্ডার করে আমাদের
১১ জনের আর একটি গ্রæপ করে দিলেন।
০৩। কল্যাণপুর যুদ্ধ: কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি
গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে
নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১
জন রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডনাধীন হয়ে হেটে ভোরে বেলকুচি উপজেলার
কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। ৫নভেম্বর ’৭১ বাড়ির মালিক
আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকেও হেটে
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি, প্যারেড করলাম। অস্ত্র
পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলতুরী মারলাম। একজন করে ডিউটি করতে থাকলাম। অন্যান্যরা
ঘুম বা রেষ্টে থাকলাম। কল্যানপুর একটি নিভৃত গ্রাম। আমাদের ধারনা ছিল এই
গ্রামে পাকি হানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত
সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমদের কে ধরার জন্য বেলকুচি
থানা থেকে কয়েকজন পাকি হানাদার মিলে শিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের
মধ্য দিয়ে কল্যানপুরের দিকে আসছে। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ
বেধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। দূর থেকে অনুমান
হলো এই দলে ৫জন মিলেশিয়া ও ৮জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার
সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যানপুরে রাস্তার ধারে বাংকারের মত বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে
পজিশন নিলাম। বাঁশ ঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে ওরা আসছিল। আমাদের
রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কমান্ড ও
ফায়ার ওপেন করলেন। এক লাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তর পার্শে¦ পজিশন নিল। ওরাও
আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছাড়তে থাকলাম।
গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশে পাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ আমাদেরকে
সহযোগীতা করার জন্য এগিয়ে এলেন। এক ঘণ্টার অধিক সময় সম্মুখ যুদ্ধ চললো।
তারপর পাকি হানাদারেরা লাশ নিয়ে পিছিয়ে গেল। এই যুদ্ধে ১জন মিলেশিয়া ও ১জন
রাজাকার মারা গিয়েছিল। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করলাম। সকল স্তরের
মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম তারপর হেটে
দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা মোঃ শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিলাম। কয়েক দিন
দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে থাকতে
থাকলাম।
০৪। ধীতপুর যুদ্ধ:ধীতপুর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার একটি গ্রাম।
এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ
প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। ১২ডিসেম্বর’৭১ আমরা শেল্টার নিলাম
সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্ত্তীর বাড়িতে। ১৩ ডিসেম্বর’৭১ সংবাদ পেলাম পাকি
হানাদারেরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকি হানাদারেরা
পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসেছে। মালিপাড়া
ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুই জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়েছে। আমরা
পাকি হানাদারদের আক্রমন করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের
একজনের মুলা ক্ষেত থেকে মুলা খাওয়ার চেষ্টা করলো। ওরা হয়তো জানতো না কাঁচা
মুলা খাওয়া যায় না। ওয়াপদা বাধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব
বজায় রেখে অস্ত্র তাক করে ওদের পিছু পিছু হাটতে থাকলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধী ধীতপুর
নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি করলো। আমরা জাম্প করে
ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম দিকে পজিশন নিলাম। ওদের উপর গুলি ছুড়লাম। ওরা ওয়াপদা বাধের
পূর্ব পার্শ্বে পজিশন নিল। এক ঘণ্টা ব্যাপি গুলি পাল্টা গুলি চলতে থাকলো। গুলির শব্দে
শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের
সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হানাদারেরা
গুলি করা বন্ধ করলো। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করলাম। সারারাত আমরা না খেয়ে
পজিশন অবস্থায় ছিলাম। আমাদের গ্রæপটি ছিল বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী
কমান্ডানাধীন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের অধিবাসি বেড়া
বিবি হাই স্কুলের এর দশ শ্রেণীর ছাত্রী মো: আব্দুল খালেক ও ছেচানিয়া গ্রামের
মো: আমজাদ হোসেন শহিদ হয়েছেন। স্থানীয় দুজন পথচারী গোলাগুলির সময়ে গুলি
লেগে মারা গিয়েছেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে
ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছিলাম। ১৪ ডিসেম্বর’৭১ শাহজাদপুর থানা হানাদর মুক্ত
হয়। ১০ জানুয়ারী’৭২ জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে দেশে
আসলেন। ১২ জানুয়ারী জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই
রাষ্ট্রপাতি পদের ইস্তেফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করে প্রধান মন্ত্রী
হিসাবে দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা
দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাদের গ্রæপ ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার সিরাজগঞ্জ সদরস্থ
ইব্রাহিম বিহারী বাসায় অস্ত্র ও গোলা বারুদ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব
শেষ করলাম।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার।
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল,পিতা: দ্বিজেন্দ্র নাথ
সান্যাল,মাতা:নিলীমা রানী সান্যাল, গ্রামও ডাকঘর: রতন
কান্দি,ইউনিয়ন: হাবিবুল্লাহনগর,উপজেলা: শাহজাদপুর , জেলা:
সিরাজগঞ্জ।গেজেট নং-বে-সামরিক সিরাজগঞ্জ-১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ –
এফ.এফ. নং-৪৭৪২। সমন্বিত তালিকা জেলা ভিত্তিক -১৪১১ , উপজেলা ভিত্তিক-১৫১
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিষ্টেম নং- ০১৮৮০০