পুরো ক্যম্পাসজুড়ে আনন্দঘন পরিবেশ। দলবেধে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ালেন নবীন-প্রবীণরা। প্রিয় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছবি-সেলফি তুলে পুরোনো স্মৃতিকে ধারণ করলেন নতুন করে। বিভিন্ন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সেসব স্মৃতি রোমন্থন করলেন অনেকেই। এমন আনন্দঘন পরিবেশে বৃহস্পতিবার পালিত হয়েছে উত্তর জনপদের নারী শিক্ষার অগ্রপথিক হিসেবে পরিচিত নীলফামারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্লাটিনাম জুবিলি (৭৫ বছর পূর্তি)।
এমন অনুষ্ঠান ঘিরে বিদ্যালয়কে সাজানো হয়েছিল নানা সাজে। কমতি ছিল না মূলফটকসহ গোটা প্রাঙ্গনে নানা রঙ্গের সাজ-সজ্জার। ছিল নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীরা পেল উপহার। মাঠে বিশাল প্যাÐেল জুড়ে হৈ হল্লার কমতি ছিল না দিনভর। তাদের মধ্যে মঞ্চে ঊছে কেউ করলেন স্মুতিচারণ। অনেকেই কুইজ প্রতিযোগিতা, রম্য বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আনন্দ ছড়িয়ে দিলেন অংশগ্রহনকারীদের মাঝে।
অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হাফিজা বেগম তোতা (৯২)। তাঁর ছেলে ডা. রেজাউল করিম রেজাকে সঙ্গে নিয়ে হুইল চেয়ারে করে এসছিলেন আনন্দ ভাগাভাগি করকে।
এসময় হাফিজা বেগম তোতা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি ১৯৫০ সালে এই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়েছি। তখন আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নূরের মা আমেনা বেগম এবং শিক্ষক ছিলেন নূরের বাবা নাজেম আহম্মেদ (আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী)। প্রধান শিক্ষিকাকে আমরা বড় আপা বলে ডাকতাম। আর নাজেম স্যারকে আমরা মাশাই ডাকতাম। মাস্টার মশাই না বলে মাশাই ডাকতাম। এটা আমাদের আদরে ডাক ছিলো। উনি আমাদের আদর করতেন। এজন্যই এই ডাক’।
স্মুতিতে গেথে থাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘একদিন আমরা বান্ধবীরা হৈ চৈ করেছিলাম, বড় আপা সেকি বকা! তখন মাশাই (আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী) এসে বড় আপাকে বললেন, তুমি এদের উপর রাগ করছো কেন। এই বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বড় আপা আমাকে প্রতিদিন পড়া ধরতেন। যত কষ্টই হোক আমি আপার পড়া মুখস্থ করে যেতাম। যতদূর মনে পড়ে আমার যে সব বান্ধবী ছিলো তারা হলো আভা, পাখি, রেবা, জাহেদা, পুরবি ও পুতু। আমার বান্ধবীর নাম পাখি আর আমার নাম তোতা সবাই আমাদের তোতা পাখি বলে খেপাতো আমাদেরকে’।
ভাষা আন্দোলনে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভুমিকার কথা স্মরণ করে বলেন,‘আমার মনে পড়ে আমরা নীলফামারী শহরে মিছিলও করেছি। ভাষা আন্দোলনের মিছিল। ভাষা সৈনিক সফিয়ার দা (সফিয়ার রহমান) আমাদের বুকে কালো ব্যাচ পড়িয়ে মিছিলে নিয়ে যেতেন। আমরা চিৎকার করে বলতাম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রেজওয়ানা রাইসা বলেন, ‘বিভিন্ন বয়সের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আজকে এখানে উপস্থিত হয়েছে, আমরা যে সময় জন্মগ্রহণও করি নি। আজকে আমাদের স্কুলে পড়া মা ও দাদি বয়সীরা এসেছেন। তাদের বান্ধবীদের নিয়ে বিভিন্ন হাসি ঠাট্টা করছেন, ছবি তুলছেন, তাদের মধ্যে যে বন্ধুত্বের বন্ধন তা দেখে আমাদের যে আনন্দ অনুুভুতি প্রকাশ পাচ্ছে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আজকে নবীন-প্রবীণের এই মিলন মেলায় যুক্ত হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে’।
এদিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান। এরপর একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিনণ করে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ফিরে আলোচনা সভায় মিলিত হয়।
এসময় নীলফামারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীমা হকের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা দেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাইদুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষার্থী ও নীলফামারী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফরিদা খানম, সাবেক শিক্ষার্থী ড. অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাজমা বেগম। সাবেক অন্যন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্মৃতিচারণ করে বক্তৃতা দেন দৌলত জাহান ছবি, তাসমিন ফওজিয়া ওপেল, তাজনূর আফছানা প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ফারহানা ইয়াসমিন ইমু।
শেষে সেখানে রতœগর্ভা বেগম জুলেখা ইসলাম ও মিসেস সাবেকুন নাহার এবং নীলসাগর গ্রæপকে সন্মাননা স্বারক প্রদান করা হয়। নীলসাগর গ্রæপের পক্ষে সম্মাননা স্বারক গ্রহণ করেন মহাব্যবস্থাপক তাপশ সাহা (জিএম)। এছাড়া ও ভাষা সৈনিক ফৌজিয়া বেগমকে মরনোত্তর সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। বিকেলে শিক্ষার্থীদের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৫ সালে নীলফামারী উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিতি ছিল জেলার নারী শিক্ষার অগ্রপথিক এ বিদ্যাপিঠ। সে সময়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেন শিক্ষানুরাগী আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী। তাঁর সকল যোগ্যতা থাকা সত্বেও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব না নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে নারী বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধান শিক্ষকের দ্বায়িত্ব প্রদান করেন তাঁর স্ত্রী আমেনা বেগমকে। প্রতিষ্ঠালগ্নে তৃতীয় শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলতো। ১৯৭০ সালের ১ ফেব্রæয়ারী বিদ্যালয়টি জাতীয় করণ হয়। জাতীয় করণের সময় নিচ ধাপের দু’টি শ্রেণিবাদ দিয়ে পঞ্চম শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম চালু রাখা হয়। অদ্যাবধি বিদ্যালয়টিতে সুচারুভাবে পাঠদান চলছে। ২০১০ সাল থেকে প্রভাতি ও দিবা শাখায় পাঠদান চলছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের দুই শাখায় প্রায় ১২৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীমা হক বলেন,‘নবীন-প্রবীণদের অংশগ্রহনে আনন্দগন পরিবেশে প্লাটিনাম জুবিলি পালিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে দুই জাহার ২৬৭ জন অংশগ্রহন করেছেন। এরমধ্যে ২০২০ সালের আগের শিক্ষার্থী ৯৩৬ জন, ২০২০ সালের পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এক হাজার ৩৩১ জন’।
#
প্রধান কার্যালয়ঃ বাবর রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
কর্পোরেট অফিসঃ
চৌধুরী ভিলা, বাসস্ট্যান্ড, জলঢাকা, নীলফামারী।
ইমেইলঃ taxashim@gmail.com
চৌধুরী মিডিয়া গ্রুপ এর একটি প্রকাশনা
Copyright © 2024 AlifNews24.net. All rights reserved.